জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা আইন ১৯২০- বাংলাদেশে এমন একটি আইন আছে, তা আমরা অনেকেই জানি না। আমি হলপ করে বলতে পারি- আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়া সাধারণেরা এ সম্পর্কে প্রথমবারের মতো শুনছে। ব্যাপারটা হলো- বেওয়ারিশ একটি কুকুরকে নিষ্ঠুরভাবে পেটানোর দায়ে রাজধানী ঢাকার রামপুরায় আটক হয়েছে তিন যুবক। থানায় মামলাটি করেন প্রাণী কল্যাণ নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের সভাপতি। এ আইনটি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পুলিশ বাহিনীকে নিশ্চয়ই অনেক পুরনো ধূলোমাখা ফাইলপত্র ঘাটতে হয়েছে।
আমাদের ইসলাম ধর্মে খুব প্রচলিত একটি কথা আছে- মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব। বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত যে, মানুষ প্রাণিজগতের সবচেয়ে উন্নত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে বিভিন্ন ধাপ অতিক্রমণের দ্বারা। মানুষ বিচারবুদ্ধি, বিবেচনাবোধ সম্পন্ন একমাত্র প্রাণী। আমাদের অজান্তে ভিনগ্রহে যদি কোনো এলিয়েন থাকে এবং তারা যদি পৃথিবী সম্পর্কে অবগত হয় তবে তারাও নিশ্চয়ই এখানে বিচরণরত সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বই স্বীকার করে নিবে। সুতরাং নিশ্চিত করেই বলা যায়- মানুষই এই মর্ত্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব।
একটি শিশু পরিবারে জন্মগ্রহণ করে বাবা-মায়ের আশ্রয়ে লালিত পালিত হতে থাকে। বাবা-মা তার সন্তানকে শাসন করতে পারবে কিন্তু শারীরিকভাবে আঘাত করতে পারবে না। উন্নত বিশ্বে এই রীতি এবং মূল্যবোধই প্রচলিত। কিছুটা বড় হয়ে শিশুটি বিদ্যার্জনের জন্য যায় বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাকে সুশিক্ষা দান করার নিমিত্তে শাসন করতে পারবে কিন্তু কোনো ধরনের শারীরিক আঘাত নয়। আমাদের দেশেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি দেয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ পারিবারিক বা সামাজিক উভয়ক্ষেত্রেই শারীরিক প্রহারকে নিগৃহীত করা হয়েছে। এটি পরিবার বা সমাজের একটি বার্তা যা নির্দেশ করে শারীরিক আঘাত হতে মানুষকে সুরক্ষিত করার। সুতরাং এটি সহজেই বোধগম্য, যেখানে সর্বাপেক্ষা আপনজন ও গুরুজনদের (শিক্ষক সমাজ) কাউকে প্রহারের অধিকার দেয়া হয়নি- সেখানে কারো অন্যকে শারীরিকভাবে প্রহারের প্রশ্নই আসে না।
কোনো মানুষ যদি কাউকে হত্যা করে- তাহলে সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদণ্ড। অর্থাৎ হত্যার বদলা সবসময় হত্যা হচ্ছে না। সুতরাং এটা বলা যেতে পারে, যেকোনো অপরাধে অপরাধীর শাস্তি অপরাধের মাত্রার তুলনায় কমই হয়ে থাকে। আর এটাই সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য। অপরাধীর অপরাধ সংঘটনকালীন তার মানসিক অবস্থা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, প্রভাববিস্তারকারী অন্য কেউ আছে কি না- এ বিষয়গুলো তার বিচারের সময় নিবিড়ভাবে বিবেচনা করা হয়।
ক্ষুধা-পিপাসা, লোভ-হিংসা, যৌনতার মতোই নিষ্ঠুরতা একটি মানবীয় প্রবৃত্তি। এসবের মাত্রায় রকমফের আছে। অর্থাৎ কারো কম কারো বেশি। তবে নিষ্ঠুরতা কারো কারো মধ্যে একদমই থাকে না। আসলে সেটি হওয়াই কাম্য। একজন মানুষের পাশবিক মনোবৃত্তির পিছনে কয়েকটি ফ্যাক্টর কাজ করে। যেমন তার বড় হয়ে উঠার পরিবেশ, তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা, অনেক ক্ষেত্রে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম, জেনেটিক কারণ আর সবশেষে হলো ধর্ম। একথা অনস্বীকার্য যে, ধর্মের প্রকৃত সর্বজনীন হিতসাধনের শিক্ষা হতে দূরে সরে গিয়ে যখন ধর্মীয় মৌলবাদকে গ্রহণ করা হয় তখনই মানুষ নিষ্ঠুর নৃশংস হতে বাধ্য। আর কিছু মানুষ আছে যারা তাদের মানবীয় কুপ্রবৃত্তি পাশবিকতাকে চরিতার্থ করে ধর্মীয় খোলস দিয়ে এবং এভাবে তারা দায়মুক্তি পেতে চায়।
এবার একটি ঘটনা প্রসঙ্গে আসি। এই পবিত্র রমজান মাসে এক শীর্ণকায় ব্যক্তি প্রকাশ্য রাস্তায় একজনের মানিব্যাগ ছিনিয়ে পালাতে চেষ্টা করে। পলায়নরত ব্যক্তি যে অতিশয় দুর্বল সেটি তার পালানোর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। দৌঁড়ে অবশ্য বেশিদূর যেতে পারেনি। তার আগেই উন্মত্ত জনতার হাতে ধরা পড়ে যায়। শুরু হয় উত্তম মাধ্যম মানে গণপিটুনি। প্রহৃত ব্যক্তি আর জীবিত ছিল কি না আমি জানি না। বাস দিয়ে আসার সময় ঘটনাটি চোখে পড়ে। ওই ব্যক্তির শারীরিক গঠন ও অবস্থা দেখে দু’টি বিষয় অনুমান করা যায়। এক হতে পারে সে ছিল খুব ক্ষুধার্ত। আরেকটি কথা বলে নেই- সে যে প্রফেশনাল কোনো অপরাধী ছিল না এটা নিশ্চিত। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে সে হয়তো অন্যের মানিব্যাগে হাত দিয়েছিল। আর আমাদের শহুরে সমাজে কারো কাছে ক্ষুধার্ত বলে একজন খাবার পাবে এমনটা সাধারণত হবার নয়। এখন ওই ব্যক্তি যদি উক্ত কারণে অন্যের মানিব্যাগ ছিনিয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে চায় তবে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা ক্ষমার যোগ্য। আরেকটা বিষয় হতে পারে- সে মাদকাসক্ত। আর একথা বিজ্ঞানসম্মত যে, মাদকাসক্তরা মানসিকভাবে অসুস্থ। তাদের মাঝে সুস্থ স্বাভাবিক চিন্তা চেতনা অনুপস্থিত। আর একজন মানসিক রোগী যদি কোনো অপরাধ করে সেটিও শিথিলভাবে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং সম্ভাব্য দু’টি কারণ বিশ্লেষণ করলে, ওই ব্যক্তির অপরাধ ক্ষমার যোগ্য। সর্বোপরি মানিব্যাগ ছিনতাই বা চুরির শাস্তি কখনো তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হতে পারে না। যেসকল সুস্থ মস্তিষ্কের, শক্ত সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা তাকে নির্মমভাবে পেটালো তাদের অপরাধ সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য।
অতি সম্প্রতি শিশু রাজনের ঘটনাটি আমাদের মনুষত্ব্যের ভিত পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়েছে। শাস্তি হোক রাজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা অপরাধীদের। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেন তাদের হয়। কারণ বিনাদোষে বা লঘু দোষে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার কারো নেই। এই অপরাধীরা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে। কারণ খেলার ছলে বা পাশবিক আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায় না। মেরে ফেলা তো দূরের কথা কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত করার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি।
জীব জন্তু, পশুপাখির প্রতি সদয় হওয়া খুবই উত্তম কথা। অহেতুক কুকুর পেটানো ওই তিন যুবকেরও শাস্তি হোক। কিন্তু তার আগে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে পেটালে সেই অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে তার শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, একটি কুকুরের চেয়ে মানুষের জীবনের মূল্য এবং সম্মান অনেক অনেক বেশি। সেজন্য আমরা প্রথমে উদ্যোগি হই মানুষের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতা বন্ধে। সর্বোপরি মানুষের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে কোনো আইনি সহায়তামূলক সংগঠন গড়ে তোলা যায় কি না তা ভেবে দেখা দরকার।
লেখক: কথাসাহিত্যিক